ঢাকা দক্ষিণ সিটির টাকা ‘তাপসের ব্যাংকে’
ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস করপোরেশনের স্থায়ী আমানতের বড় অংশ নিজের ব্যাংক মধুমতিতে জমা রেখেছেন। সিটি করপোরেশনের আর্থিক লেনদেনও অন্য ব্যাংক থেকে সরিয়ে মধুমতিতে নিয়েছেন।
ফজলে নূর তাপস ২০২০ সালে মেয়র হন। এরপর তিনি সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে নজর দেন। আয় বাড়লেও উন্নয়নমূলক কাজে তাঁর জোর ছিল না; বরং সিটি করপোরেশনের টাকা নিজের ব্যাংকে রাখতে মনোযোগী ছিলেন তিনি।
শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র থাকাকালে নগর ভবন ও দক্ষিণ সিটির আঞ্চলিক কার্যালয়ে বসানো হয়েছে মধুমতি ব্যাংকের ছয়টি বুথও; যেখানে মানুষ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সেবার বিপরীতে টাকা জমা দিতে পারে। অন্য ব্যাংককে এই সুযোগ দেওয়া হয়নি।
২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া মধুমতি ব্যাংকের উদ্যোক্তা মূলত শেখ ফজলে নূর তাপস। তখন এটি ‘তাপসের ব্যাংক’ নামে পরিচিতি পায়। এখনো তিনি ব্যাংকটির পরিচালক।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে তাদের স্থায়ী আমানত ছিল ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৪৩ কোটি টাকা রাখা আছে মধুমতি ব্যাংকে, যা মোট অর্থের ৪৬ শতাংশ। বাকিটা রয়েছে জনতা ও প্রিমিয়ার ব্যাংকে।
সিটি করপোরেশনের টাকা মূলত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে রাখা হতো। ২০১৮ সালে সরকার নিয়ম বদলে সরকারি সংস্থার টাকা বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেয়। মেয়র হয়ে তাপস করপোরেশনের টাকা মধুমতি ব্যাংকে রাখা শুরু করেন।
স্থায়ী আমানতের বাইরে দক্ষিণ সিটির চলমান সাতটি প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটির টাকাই মধুমতি ব্যাংকে রাখা আছে। পরিমাণ ৪২৩ কোটি টাকা, যা সাত প্রকল্পের মোট টাকার ৭৬ শতাংশ। প্রকল্পের বাকি টাকা রাখা আছে সোনালী ও জনতা ব্যাংকে। স্থায়ী আমানত ও প্রকল্পের টাকা মিলিয়ে মধুমতি ব্যাংকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯৬৬ কোটি টাকা রয়েছে।
করপোরেশনের টাকা নিজের ব্যাংকে রাখতে বাধ্য করাকে স্বার্থের সংঘাত বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বলে মনে করেন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
শেখ ফজলে নূর তাপস শপথের বরখেলাপ করে তাঁর মালিকানাধীন ব্যাংকে অর্থ লগ্নি করেছেন। এটা স্বার্থের দ্বন্দ্ব। কাজটি অনৈতিক হয়েছে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি অঙ্গীকারের বরখেলাপ করেছেন।
মেয়র হয়েই টাকা মধুমতি ব্যাংকে
দক্ষিণ সিটিতে চার বছর তিন মাস মেয়র ছিলেন ফজলে নূর তাপস। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। ওই নির্বাচনে মাত্র ২৯ শতাংশ ভোট পড়ে; আর তাপস পান ১৭ শতাংশের কিছু বেশি ভোট।
শেখ ফজলে নূর তাপস দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০২০ সালের মে মাসে। সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, মেয়র হয়েই তিনি করপোরেশনের স্থায়ী আমানত ও চলতি লেনদেনের বড় অংশ মধুমতি ব্যাংকে নিতে বাধ্য করেন।
মাস শেষে হিসাব নিয়ে গেলেই শেখ ফজলে নূর তাপস টাকাগুলো মধুমতি ব্যাংকে জমা রাখতে বলতেন। এমনকি নানা অজুহাতে ঠিকাদারদের বিল আটকে রেখে সেই টাকা মধুমতি ব্যাংকে রাখা হতো। ওই কর্মকর্তা বলেন, মধুমতি ব্যাংকে টাকা আরও বেশি ছিল। প্রকল্পের টাকা খরচ হওয়ায় গত সেপ্টেম্বরে জমার পরিমাণ কমেছে।
মধুমতি ব্যাংক ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন একসঙ্গে নয়টি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। মধুমতি ব্যাংকের মূল উদ্যোক্তা শেখ ফজলে নূর তাপস সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ৯টি ব্যাংকের কয়েকটির অবস্থা ভালো নয়। তবে মধুমতি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো। নতুন ব্যাংকগুলোতে টাকার জোগান বাড়াতে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারি সংস্থার তহবিল ব্যবস্থাপনায় নতুন নিয়ম করে। নতুন নিয়মে ৫০ শতাংশ অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়।
করপোরেশনের টাকা নিজের ব্যাংকে রাখার বিষয়ে চেষ্টা করেও শেখ ফজলে নূর তাপসের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুই দিন আগে তিনি হঠাৎ দেশ ছাড়েন। সূত্র বলছে, এখন তাঁর অবস্থান সিঙ্গাপুরে।
সেই ব্যাংকে সিটি করপোরেশনের টাকা রাখা নৈতিকভাবে ঠিক কি না?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ব্যাংকে তো আমানত রাখা যায়। আমানত রাখলেই কিন্তু ওই ব্যাংকের মুনাফা হয়ে যায় না। ব্যাংক মুনাফা করলে তার ভাগ তো আপনার কাছেও যাবে, যেহেতু আপনি পরিচালক—এমন প্রশ্নে তখন তাপস বলেছিলেন, সিটি করপোরেশনের কোনো কিছু এখন পর্যন্ত মধুমতি ব্যাংকের বোর্ডে যায়নি, যেখানে একজন পরিচালক হিসেবে ইনফ্লুয়েন্স (প্রভাবিত) করার কোনো সুযোগ আছে।
যদিও বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা আগেই ছিল। দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি এক কর্মসূচিতে বলেছিলেন, তাপস দক্ষিণ সিটির শত শত কোটি টাকা তাঁর নিজ মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, সাঈদ খোকনের সময়ও তাঁর পছন্দের কিছু ব্যাংকে সিটি করপোরেশনের টাকা রাখা হতো। উল্লেখ্য, বড় অঙ্কের টাকা কোনো ব্যাংকে রাখা হলে সেখান থেকে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা নেওয়া যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন